ইক্ষু একটি অন্যতম খাদ্য তথা শিল্পজাত ফসল। এটিকে দুর্যোগ সহনশীল ফসল বলা হয়, যা খরা, বন্যা ও জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু। বাংলাদেশে ৩০টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের ১২টিতে মোট ০.১৭ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে ইক্ষু ভালো হয়। তবে সারা দেশেই চিবিয়ে খাওয়া ও গুড় উৎপাদনকারী আখের জাত চাষ করা হয়। একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের সুষ্ঠু বিকাশে প্রতি মিনিটে ১০০ গ্রাম ব্রেনের জন্য ৭৭.০ মিলিগ্রাম গ্লুকোজ প্রয়োজন। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার সুপারিশ মতে প্রতি বছর ন্যূনতম ১০ কেজি চিনি ও ৩ কেজি গুড় খাওয়া প্রয়োজন। এ হিসাবে বর্তমানে ১৬ কোটি লোকের জন্য প্রায় ২১ লাখ টন চিনি ও গুড় প্রয়োজন। কিন্তু দেশে প্রতি বছর উৎপাদন হচ্ছে চিনি ১.৫ লাখ টন ও গুড় ৬ লাখ টন। তাহলে ঘাটতির পরিমাণ হলো প্রায় ১৪ লাখ টন। যদিও বেসরকারি রিফাইনারি কোম্পানিগুলো বিদেশ থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে পরিশোধিত আকারে দেশের চাহিদার জোগান দিয়ে থাকে। এতে আমাদের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়।
বাংলাদেশে প্রায় ১৬ লাখ চাষি ইক্ষু চাষ করে থাকে এবং প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ইক্ষু চাষের ওপর নির্ভরশীল। এতে প্রতি বছর ৬.৬ কোটি লোকের কর্মসংস্থান হয়। জাতীয় অর্থনীতিতে ইক্ষুর অবদান প্রায় ০.৭৪%, যা টাকার অঙ্কে প্রায় ১৫২২ কোটি টাকা আর ফসল উপখাতে ইক্ষু আবাদি জমির অবদান ২.০৫% কিন্তু কৃষি জিডিপিতে এর অবদান ৫.৫২%।
এ দেশে সব ধরনের জমিতে ইক্ষু চাষ হয় তবে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাযুক্ত উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি ইক্ষু চাষের জন্য উপযোগী। তবে চরের বালুময় পতিত জমি, পাহাড়ি বন্ধুর জমি ও লবণাক্ত জমি যেখানে অন্যান্য ফসল চাষ করা কষ্টসাধ্য সেসব এলাকায় সফলভাবে ইক্ষু চাষ করা হচ্ছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বাড়ির আঙ্গিনায় ইক্ষু চাষ ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করছে। পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয় যে, কোনো কৃষকের বসতবাড়ির ভিটায় (২.৫ শতাংশ জমিতে) ২২০টি চিবিয়ে খাওয়ার উপযোগী ইক্ষু চারা থাকে এবং প্রতিটি ইক্ষু চারা থেকে গড়ে ৬টি মাড়াইযোগ্য ইক্ষু হিসেবে ২২০x৬ = ১৩২০টি বিক্রয়যোগ্য ইক্ষু পাওয়া যায়, যা আশ্বিন-কার্তিক (অর্থনৈতিক মন্দা মাস) মাসে ১০ টাকা হিসেবে বিক্রয় করলে ১৩২০x১০=১৩২০০ টাকা বাড়তি আয় হবে, যা তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য সহায়ক। আর উপকূলীয় দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় জলোচ্ছ্বাস বা জোয়ারের পানিতে যখন সব ধরনের ফসল ভেসে যায় তখনও ইক্ষু মাথা উঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বিশেষ করে দুর্যোগের ২-৩ দিন খাদ্যের অভাবে যখন মহামারী হয় তখন ইক্ষুর রস তৎক্ষণাৎ খাবার হিসেবে কাজ করতে পারে। কেননা ইক্ষু রস একটি পুষ্টিকর পানীয়। সাধারণত ১ গ্লাস ইক্ষুর রস থেকে ২৭ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি পাওয়া যায়।
ইক্ষু এমন একটি ফসল যার কোনো অংশ ফেলে দেয়া হয় না। ইক্ষু থেকে আমরা চিনি, গুড়, মোলাসেস (নালি), ব্যাগাসী (ছোবড়া) ও প্রেসমাড পেয়ে থাকি। সুতরাং ইক্ষু একমাত্র ফসল, যা ভারী শিল্প ও গ্রামীণ ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের দেশে উৎপাদিত কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে প্রায় ৬ লাখ টন গুড় উৎপন্ন হয়। গুড় এ দেশের একটি গ্রামীণ শিল্প। বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থ ও ভিটামিন থাকার কারণে গুড় চিনির চেয়ে অধিকতর পুষ্টি মানের। এছাড়া আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে গুড়ের ব্যবহার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উপরন্তু গুড়ের একটি বিশেষ ভোক্তা শ্রেণী রয়েছে। অতি প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশে তাল, খেজুর ও ইক্ষুর গুড়ই একমাত্র মিষ্টান্ন তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। রসাগুড়, দানাদার গুড়, পাটা গুড়, পাটা চিনি ও খাঞ্জেশ্বরী গুড় এ দেশেরই ঐতিহ্য। প্রাকৃতিক নানাবিধ উপাদান গুড়ের সঙ্গে মিশে থাকায় স্বাস্থ্য ও পুষ্টিমানে উন্নত ও সাদা চিনির চেয়ে অধিকতর নিরাপদ। পূর্বে বলা হতো গুড় আমদানি ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য নয়। কিন্তু বর্তমানে গ্লোবাল ভিলেজ আমাদের এ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এনেছে। কিছু প্রতিষ্ঠান নিজ উদ্যোগে খাঞ্জেশ্বরী গুড় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য রপ্তানি করছে।
খাবার হিসেবে ইক্ষুর কাণ্ড সরাসরি চিবিয়ে রস পান করা হয়। ইন্দোনেশীয়ায় ইক্ষু কাণ্ড থেকে স্যুপ তৈরি করা হয়। এছাড়া ইক্ষু থেকে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করা হয়। কলোম্বিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও মধ্য আমেরিকায় ইক্ষুর রস থেকে তৈরি পেনেলা নামের জনপ্রিয় খাবার প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ইক্ষু থেকে চকোলেট, ক্যান্ডি ও ইক্ষুর রস কোমল পানীয় তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। আর ইক্ষু থেকে চিনি তৈরি হয়, যা বিশ্বে সার্বজনীন মিষ্টি দ্রব্য হিসেবে সমাদৃত ও মিষ্টিজাতীয় বিভিন্ন দ্রব্য তৈরির প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইক্ষুর উপজাতসমূহের অর্থনৈতিক বহুমুখী ব্যবহারকল্পে ইক্ষু থেকে যে মোলাসেস তৈরি হয় তা থেকে ইথানল পাওয়া যায় যা বায়োফুয়েল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ব্রাজিলে মোটর গাড়ি চালনার জন্য ইথানলকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের দেশে স্বল্প পরিসরে পরীক্ষামূলকভাবে ইথানল ব্যবহারের মাধ্যমে গাড়ি চালানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর যেমন চাপ কমবে, অন্যদিকে বিদেশ থেকে জ্বালানি তেল আমদানিতে যে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয় তা সাশ্রয় হবে। ইক্ষুর উপজাত ব্যাগাসী থেকে বিদ্যুৎ, কাগজ তৈরির পাল্প এবং বায়োগ্যাস পাওয়া যায়। মরিশাসে ১ টন ব্যাগাসী থেকে ১০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ইক্ষুর ছোবড়া বা ব্যাগাসী থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প হাতে নেয়া যেতে পারে যা থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা যায়। এ ছাড়া প্রেসমাডকে জৈবসার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এতে প্রায় ২০% জৈব পদার্থ থাকে। জৈব পদার্থ মাটির প্রাণ। আমাদের দেশের মাটির জৈব পদার্থ দিন দিন কমে যাচ্ছে। একটি ভালো কৃষি জমির ফসল ফলানোর জন্য ২% এর উপরে জৈব পদার্থ থাকতে হয়। তবে আমাদের দেশের অধিকাংশ মাটিতে ১.৫% এর নিচে জৈব পদার্থ আছে। কাজেই মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মাটিতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পচানো প্রেসমাড প্রয়োগ করা যেতে পারে এবং কারখানায় প্রেসমাড থেকে জৈবসার তৈরি করে বাজারজাত করা যেতে পারে।
চিনিকলগুলোতে চিনি তৈরির প্রধান কাঁচামাল হলো ইক্ষু। তবে চিনিকলগুলোর বর্তমান মাড়াই অবস্থা ভালো নয়। চিনিকলগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২.১ লাখ টন। আর বর্তমানে বাংলাদেশে চিনি ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ১৪ লাখ টন। পরিকল্পিত নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে চিনিকলগুলোর প্রভূত উন্নতি করে একদিকে যেমন চিনি ঘাটতির পরিমাণ কমানো যায় অন্যদিকে তেমনি ইক্ষুর উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। উপসংহারে এ কথা বলা যায়, ইক্ষু হলো এমন একটি অর্থকরী ফসল যার সব অংশ ব্যবহার যোগ্য। এটি যেমন খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায় তেমনি কুটির শিল্পের ও ভারী শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর ইক্ষুর উপজাতসমূহের বহুমুখী অর্থনৈতিক ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
ড. খন্দকার মহিউল আলম*
ড. মু. খলিলুর রহমান**
* ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকা ও পুষ্টি বিভাগ, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী-৬৬২০, পাবনা
** মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী-৬৬২০, পাবনা